গণআন্দোলনের নতুন চেতনা - একুশ শতক
গণআন্দোলনের নতুন চেতনা
গণআন্দোলনের নতুন চেতনা - ekush shatak

গণআন্দোলনের নতুন চেতনা

পশ্চিমবাংলার গণতান্ত্রিক আন্দোলনের গৌরাবোজ্জ্বল ইতিহাসে ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২১ আরও একটি নতুন পৃষ্ঠা সংযোজন করল৷ বামপন্থী ছাত্র-যুব সংগঠনগুলি এই ১১ ফেব্রুয়ারি কলকাতা মহানগরীতে হাজার হাজার ছাত্র-যুবকে সমবেত করে রাজ্য প্রশাসনের নতুন কেন্দ্র নবান্ন অভিযান করে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীকে রিলিজ অর্ডার ধরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পিত আন্দোলনের কথা ঘোষণা করেছিল ৪০ দিন আগে  ২ জানুয়ারি এক সাংবাদিক সম্মেলনে৷ এই আন্দোলনে সহযোগী ছিল বিভিন্ন ছাত্র-যুব সংগঠন এবং জাতীয় কংগ্রেসের অনুগামী ছাত্র-যুব সংগঠনও৷

২০১১ সালে বামফ্রন্ট সরকারের পতন ঘটিয়ে মমতার তৃণমূল ক্ষমতাসীন হওয়ার সময় ছাত্র-যুবদের যে তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তার একটিও রক্ষা করার কথা ভাবেননি মমতা৷ শিল্প ও কৃষির বিকাশ ঘটিয়ে কর্মসংস্থান করা হবে, লক্ষ লক্ষ যুবক যুবতি কাজ পাবেন, শিক্ষাঙ্গন দলবাজিমুক্ত করে উচ্চমানের শিক্ষার ব্যবস্থা করা হবে ইত্যাদি নানা প্রতিশ্রুতি শোনা গিয়েছিল৷ কিন্তু বাস্তবে তার কিছুই হয়নি৷ ছাত্র-যুবদের সঙ্গে সম্পূর্ণ প্রতারণা করা হয়েছে৷ হাজার হাজার খালিপদে নিয়োগ বন্ধ আছে বছরের পর বছর৷ শিক্ষক নিয়োগ বন্ধ৷ পার্শ্বশিক্ষক, মাদ্রাসা শিক্ষক, চুক্তিভিত্তিক শিক্ষক ও কর্মীরা মাসের পর মাস রোদ ঝড় বৃটিতে রাস্তায় বসে আছেন৷ কোনো নিয়োগই সুষ্ঠুভাবে দুর্নীতিমুক্ত পথে হয়নি, হয়েছে লক্ষ লক্ষ টাকার বিনিময়ে৷ শ্রমজগতে নবাগতরা এক দমবন্ধ করা পরিবেশে দিনযাপন করছেন৷

মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, দশ বছর মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকতে হবে, বাংলার যৌবন সেই নির্দেশ মানেনি৷ তারা পথে নেমে গণতান্ত্রিকভাবে প্রতিবাদ ধ্বনিত করেছে বারবার৷ কিন্তু সেই শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক প্রতিবাদও পুলিশের লাঠি কাঁদানে গ্যাস গুলি মিথ্যামামলার হয়রানি, এলাকা ছাড়া করা, থানায় ডেকে মারধোর, শাসকদলে যোগ দিতে বাধ্য করা ইত্যাদি ভয়ংকর অগণতান্ত্রিক পদক্ষেপ ও হিংস্রতার শিকার হয়েছে৷

গণতন্ত্রের প্রতি নূন্যতম শ্রদ্ধা না থাকলে সেই সরকারকে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে হুঁশ ফেরানোর প্রক্রিয়াটি বেশ কঠিন ও বিপজ্জনক হয়ে ওঠে৷ এই প্রেক্ষাপটেই সম্ভবত ছাত্রযুবরা ঠিক করেছিলেন, খেলার মাঠে যেমন নানা রঙের কার্ড দেখিয়ে রেফারি খেলা নিয়ন্ত্রণ করেন, সেরকম মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীকে সরাসরি রেড কার্ড দেখিয়ে সরকার পরিচালনার দায় থেকে প্রতীকী রিলিজ অর্ডার ধরিয়ে দেবেন৷ নিরস্ত্র গণতান্ত্রিক আন্দোলন এইভাবেই জনসমর্থনের ভূমি স্বপক্ষে টেনে আনে, আন্দোলন নতুন ধাপে উন্নীত হয়৷ কিন্তু স্বৈরাচারী শাসকরা নূন্যতম বিরোধীতাও সহ্য করতে জানে না৷ তারা চারপাশে স্তাবক পরিবৃত হয়ে, শুধু মনগড়া সাফল্যর ছবি আঁকে৷

গত দশ বছরে গণতান্ত্রিক আন্দোলন তাই বারবার আক্রান্ত হয়েছে৷ মিথ্যামামলা নির্মাণ করা হয়েছে কয়েক লক্ষ, লাঠি-গুলি পুলিশি অভিযান আর নির্মম অত্যাচারের মুখোমুখি হতে হয়েছে৷ কোনো গণতান্ত্রিক আন্দোলনই নিরামিষভাবে সমাপ্ত হতে পারেনি৷ ‘লাঠি-গুলি আর গুণ্ডামির সরকার’ স্বৈরাচারীদের সহজাত শিরোপা, এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি৷ প্রতিহিংসার আর নিষ্ঠুরতার নতুন বর্ণমালা তৈরি হয়েছে এই দশ বছরে৷

বাঁকুড়ার গ্রামীণ যুবক মইদুল ইসলাম মিদ্যা নির্মম লাঠি আর হিংস্র বর্বরতার শিকার হলো ১১ ফেব্রুয়ারি দুপুরে৷ দায়িত্বজ্ঞানহীন পুলিশ ও উর্দিপরা তৃণমূলের ঠ্যাঙারেবাহিনী তাকে মৃত্যুর মুখে ফেলে রেখে গিয়েছিল৷ সামান্যতম চিকিৎসার ব্যবস্থাও করা হয়নি, যা কোনো গণতান্ত্রিক দেশে কল্পনাও করা যায় না৷ সেদিন পাঁচশোজনের মতো ছাত্র-যুব আহত ও রক্তাক্ত হয়েছিলেন৷ তাদের উদ্ধার করতে আসা অ্যাম্বুলেন্সও ঢুকতে বাধা পেয়েছে বারবার৷ হত্যা অভিযানেই যেন নেমেছিল পুলিশ ও গুণ্ডাবাহিনী৷ এলোপাথারি লাঠিচার্জ করেছে, মেয়েদের লাঞ্ছিত করে শ্লীলতাহানির চেষ্টা করেছে৷ অশ্লীল উত্তেজক প্ররোচনামূলক মন্তব্য করে পরিবেশ উত্তপ্ত করেছে৷ গণআন্দোলনের প্রাঙ্গণে পুলিশ ও গুণ্ডাদের এ-জাতীয় ভূমিকা অভিনব এবং বিপজ্জনক৷

সরকারের লাঠি-গুলি গণআন্দোলন স্তব্ধ করতে পারে না৷ বারবার তার রূপ বদল হতে থাকে, ভাড়াটে বাহিনী কোনোদিনই শেষপর্যন্ত চূড়ান্ত সফল হয় না৷ প্রতিহিংসার বিরুদ্ধে পালটা হিংসা তৈরি হলে আন্দোলনের অভিমুখ বদল হয়ে যায়৷ অনেক সময় শাসকদল সেই ভ্রান্তি ছড়াতে চায়৷ তাহলে ইট পাটকেল বোমা ছুরি পাইপগান নিয়ে সরকারি কর্মীদের আক্রমণ করার গল্প ছড়ানো সহজ হয়৷ তাই সতর্ক থাকতে হবে আন্দোলনকারীদের৷ কোনো প্ররোচনার ফাঁদে পা না দিয়ে উপযুক্ত সময় ও সুযোগ খুঁজে নিতে হবে৷ গণতান্ত্রিকভাবেই ব্যাপক মানুষকে সমবেত করে স্বৈরশক্তিকে বিচ্ছিন্ন করতে হবে৷

এই রাজ্যে নির্বাচন আসন্ন৷ প্রস্তুতি তুঙ্গে৷ যেকোনো সময়ে নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণা করা হতে পারে৷ প্রশ্ন উঠেছে নির্বাচনে বামপন্থীদের ভূমিকা কতটুকু৷ বেশ কয়েক বছর থেকেই সবস্তরের গণমাধ্যমকে স্বৈরশক্তি নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবহার করছে৷ প্রচারের ধরন বদল করে বোঝানোর চেষ্টা হচ্ছে তৃণমূলকে সরিয়ে বিজেপি আসলেও আসতে পারে, কিন্তু বামপন্থীদের কোনো জনসমর্থন নেই৷ সংগঠিত বামসমর্থকদের মনে বিভ্রান্তি ও হতাশা ছড়ানোই তাদের মূল লক্ষ্য৷ তৃণমূল সরকার বিরোধী প্রবল স্রোত প্রবাহিত হচ্ছে, জনরোষ ক্রমশ বাড়ছে, সমাজের সবস্তরের মধ্যেই অসন্তোষ জমাট বাঁধছে, তাই মানুষ সামান্য সুযোগ পেলেই কোটের ওপর বসা মাছি তাড়ানোর মতো তৃণমূল ও মমতাকে ঝেড়ে ফেলে দিতে পারেন, এই আশঙ্কায় মালিকশ্রেণির অনুগত দলদাস গণমাধ্যম ‘বাইনারি তত্ত্ব’ আওড়াচ্ছে৷ সেই তত্ত্ব অনুসরণ করে অনেকেই বলতে শুরু করেছেন, আর তো কোনো বিকল্প নেই, হয় তৃণমূল নয়তো বিজেপি৷ মাঠে ময়দানে পাড়ার অশিক্ষিত রমণীদের মতো যে অশ্লীল খিস্তি খেউর, যে দাপাদাপি, হুংকার, আমি-চোর না তুই-চোর জাতীয় নগ্নকরণ খেলা—সবই আবরণ মাত্র৷

বিকল্প নেতা না, চাই বিকল্প নীতি৷ লক্ষ করলে দেখা যাবে, নীতিগত প্রশ্নে বিজেপি তৃণমূলের কোনো বিরোধ নেই, নির্বাচনের সময়ও তাই একটি বাক্যেও জাতীয় আন্তর্জাতিক কিংবা সামাজিক-অর্থনীতিক প্রসঙ্গের অবতাড়না নেই৷ নীতিগত প্রশ্নে কোনো বিরোধ তাদের নেই৷ তাই বাড়িতে ডেকে পায়েস মালপো ভোগ দিতেও দ্বিধা নেই, আবার পায়ে লুটিয়ে পরে পরিবার-পরিজন ও সম্পত্তি রক্ষা এবং ইডি সিবিআই থেকে বাঁচানোর আকূল আবেদন জানাতেও কোনো সংকোচ নেই৷

অথচ কোনো কোনো মহাপণ্ডিত মানুষ ভাবনা ছড়িয়ে দিয়ে বলছেন, যদি ত্রিশঙ্কু বিধানসভা হয়ে যায়, তখন বিজেপিকে ঠেকাতে বামরা কী করবে? তৃণমূলকেই সমর্থন দেবে না? তৃণমূল বিদায় করে বিজেপি এলে কী হবে? এই ভয়ংকর প্রচার প্রতিহত করে তৃণমূল-বিজেপির অথবা সংক্ষেপে ‘বিজেমূলে’র প্রকৃত বিকল্প সাধারণ মানুষের সামনে তুলে ধরতে হবে৷

বিকল্প নেতা নয়, বিকল্প নীতি চাই, চাই সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ৷ জনমানসের এরকম দোদুল্যমানতা নির্মূল করে প্রকৃত বিকল্প যে বামপন্থা এবং বামফ্রন্ট, জাতীয় কংগ্রেস ও সহযোগী দলসমূহের মিলিত তৎপরতায় তৃণমূলকে বিদায় করে নতুন সরকার গঠনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করা সম্ভব—এই বিশ্বাস ও প্রতীতি ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে বামপন্থী ছাত্র-যুবরা বড়ো ভূমিকা নিতে পারেন৷ যে অভিযোগ নবান্নে জানাতে গিয়ে ছাত্র-যুবরা লাঠি কাঁদানেগ্যাস ও হিংস্র গুণ্ডাদের আক্রমণে আহত ও রক্তাক্ত হয়ে ফিরে এসেছেন, সেই অভিযোগের মর্মবস্তু ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়ে শহিদ মইদুল ইসলাম মিদ্যার হত্যাকারীদের শাস্তি সুনিশ্চিত করাই হবে প্রতিহিংসা ও বর্বর আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রকৃত গণতান্ত্রিক প্রতিবাদ৷

যে-তরুণসমাজ আওয়াজ তুলেছেন, ‘সব কিছু মনে রাখা হবে’, তাঁদের সেই দৃপ্ত ঘোষণা বাঙময় হয়ে উঠলে পশ্চিমবাংলার গণআন্দোলন আবার তার অতীত গৌরব পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হবে৷ তরুণের স্বপ্ন বাস্তবায়নে সমগ্র সমাজ প্রত্যয়দৃঢ় হয়ে উঠুক৷ ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২১ হয়ে উঠুক পশ্চিমবাংলার গণআন্দোলনের নতুন চেতনা৷