স্মৃতির শঙ্খ ঘোষ : অমলিন চিরজীবী
- May 28, 2021
- একুশ শতক
আমার শ্রদ্ধেয় সহকর্মী, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শঙ্খ ঘোষ, প্রখ্যাত কবিকে সর্বগ্রাসী কোভিড কেড়ে নিয়ে গেল। এ ক্ষতির পরিমাপ হয় না। তিনি শুধু কবিতায় নয়, দেশের দশের যন্ত্রণার জন্য, কি উদ্ধত সমাজশাসকদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে পথে নেমেছেন। বহু মানুষকে সঙ্গে নিয়ে।
শঙ্খ ঘোষের সঙ্গে আমার পরোক্ষ পরিচয় জলপাইগুড়িতে। আমার দিদির বান্ধবী প্রতিমাদির (ইভা বিশ্বাস) বিয়ে উপলক্ষ্যে। শুনি তার শঙ্খ ঘোষের সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে। তিনি কবি।
সে ছিল আমার কিশোর কাল। এরপর যৌবনে পা দিয়ে আমি আসি শিবপুর বি-ই কলেজে ছাত্র হয়ে। কলকাতা অচেনা শহর। চেনার চেষ্টা চলছে। তখন প্রেসিডেন্সি কলেজের রেলিংয়ে বই ঝুলত। একটি বই ‘দিনগুলি রাতগুলি’– কবি শঙ্খ ঘোষ। তৎক্ষণাৎ কিনে ফেলা।
এরপর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় শঙ্খ ঘোষের সঙ্গে আমার প্রত্যক্ষ পরিচয় ঘটিয়ে যদিল। আমাদের ফ্যাকালটি দুটি—–উত্তরে আর্টস, দক্ষিণে এঞ্জিনিয়ারিং। মাঝামাঝি জায়গায় ফ্যাকাল্টি ক্লাব। সেখানে দুপুরের ক্লাসের বিরতিতে দুই ফ্যাকাল্টিরই বেশ কিছু অধ্যাপক আসেন। চা-কফি কিছু খাবারদাবার লভ্য। সেখানেও শঙ্খ ঘোষ, , সুবীর রায়চৌধুরী, মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখদের নিয়মিত দেখা যায়। এখানেও দুই ফ্যাকাল্টির অধ্যাপকদের কিছু দূরত্ব চোখে পড়ে। তবে আমি উভচর। কেননা তখন আমার অধ্যাপনা ছাড়াও দুটি শক্ত ডানা গজিয়েছে। এক, আমার বেশ কিছু গল্প ওজনদার পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে। দুই, আমাদের শিক্ষকদের সংগঠন জুটার কাজে (যাদবপুর ইউনিভার্সিটি টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন) আমি একটু ডানা ঝাপটাচ্ছি। লায়েক গোছের!
এই সময় দেখি শঙ্খ ঘোষ কবি বলে দূরে নেই—জুটায়ও প্রতিনিধিত্ব করেন। সেখানেও মৃদুভাষী। বক্তব্যে অটল। সেবার আমি সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত। আমরা বেশ কিছু উৎসাহী প্রতিনিধি জুটার ‘মুখপত্র’ নামে একটি ম্যাগাজিন বের করার সিদ্ধান্ত নিই। সহসা আমি একটু চমকে । শঙ্খ ঘোষ স্বেচ্ছায় বলে ওঠেন— আমি মুখপত্রের প্রুফ দেখে দেব। তাঁর মতো একজন বহু কর্মে ব্যস্ত মানুষের এই দায়িত্ব! কিন্তু কাজের বেলায় দায়িত্ব পালনে আরও তীক্ষ্ণ মনোযোগী! এমন মানুষ কি শ্রদ্ধেয় হয়ে ওঠেন না। অথচ সম্পূর্ণ নিরহঙ্কার। সাদা ধুতি-পাঞ্জাবিতে বড়ো মানানসই হয়ে যান। ফলে নিরুচ্চার বন্ধুত্ব, সহযোগ।
এই সময়ে লেখালেখির বিষয়ে যেমনটা ঘটার কথা— তাই ঘটে। কলেজ স্ট্রিটের কিছু বন্ধুবান্ধবের উৎসাহে উদ্দীপনায় ‘প্রত্যক্ষ’ নামের একটি সাহিত্যপত্র সম্পাদনায় লেগে পড়ি। প্রথম সংখ্যার লেখকসূচির কথা ভাবতেই শঙ্খ ঘোষ প্রস্তাবে রাজি। এবং প্রায় যথাসময়ে পেয়ে যাই একটি নিবন্ধ—’গানের তথ্য, গানের সত্য’।
পড়তে পড়তে আর অবাক হই না। শঙ্খ ঘোষ আমার সব চমক কেড়ে নিয়েছেন। লিটল ম্যাগাজিনে লেখা সাধারণত ধরে নিই এলেবেলে লেখা। না—আসলে যিনি বিশ্বসাহিত্যের অনেক গভীর বহু কিছু জানেন, তার লেখায় স্বতঃস্ফূর্ত সেই গভীরতা। পাঠকের শ্রদ্ধেয় বিস্ময়।
তার নিবন্ধে মায়াকভস্কির দীর্ঘ সেই প্রসিদ্ধ কবিতা : ট্রাউজারপরা মেঘ। রবীন্দ্রনাথের কবিতা সানাই প্রসঙ্গ। প্যারিসে কবি রিলকের “অর্ফিয়ুসের প্রতি সনেট’-এর প্রাসঙ্গিকতা। এরপরে শান্তিদেব ঘোষের গাওয়া রবীন্দ্রনাথের নির্বাচিত কিছু গানের একটি লং প্লেইং-এর কথা। তারও সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায় ‘গানের তথ্য ও গানের সত্য’ প্রসঙ্গে আরও বিস্তারিত গভীর আলোচনা।
তথ্য যে নিমিত্তমাত্র, তাকে ছাড়িয়ে প্রকৃত সত্যই ‘গানের সত্যে’ উত্তীর্ণ হওয়াই বড়ো কথা। তবে পাঠকের কৌতূহলও তৃপ্ত হয় কবির জীবনের সামান্য কথাও কী অপূর্ব সৃষ্টি হতে পারে।
যাহোক ‘প্রত্যক্ষ’র এই প্রথম সংখ্যা প্রথম বর্ষ মহালয় ১৩৮৭। এরপরে আরও দুটি সংখ্যাও বের হয়। তারপর যথারীতি ফুলস্টপ। কিন্তু শঙ্খ ঘোষ যে কেমন কবি ও প্রাবন্ধিক তার স্মৃতি অম্লান হয়ে ওঠে ক্রমে।
আর এইসব প্রসঙ্গে আমার কৈশোরের জলপাইগুড়ির সেই শঙ্খ ঘোষের আত্মীয়তার কথাও স্মৃতিবদ্ধ হয় কৌতুকে। আমার বিবাহের কিছু পরে তিনি নিজে আমাদের বাড়িতে আসেন। হাতে তুলে দেন ‘তিথিডোর’। লেখেন যা তার ছবি রয়ে গেছে আজও।
কিন্তু এসব কিছু ছাপিয়ে আমার সবচেয়ে প্রিয়, শ্রদ্ধেয় সেই শঙ্খ ঘোষ যিনি শুধু কবিতায় নয়, দেশের-দশের জীবনযন্ত্রণার জন্য দায়ী উদ্ধত সমাজশাসকদের বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিবাদ জানান, পথে নামেন অজস্র মানুষকে সঙ্গে নিয়ে। এই শঙ্খ ঘোষ অমলিন চিরজীবিত থাকুন।
লেখক – সমীর রক্ষিত