ছেড়ে - রেখেই ধরে - রাখা - একুশ শতক
ছেড়ে – রেখেই ধরে – রাখা
ছেড়ে - রেখেই ধরে - রাখা - Ekush Shatak

ছেড়ে – রেখেই ধরে – রাখা

স্তব্ধ হয়ে গেল সেই স্বর, স্তব্ধ হয়ে গেল সেই কবিতার মুহূর্ত—যে মুহূর্তের ছোঁয়ায় থেমে যেত আমাদের সমস্ত কোলাহল। চারপাশে সমাজের প্রবাহিত গরল শুষে নিয়ে যিনি বইয়ে দিতেন নির্মল অতলান্ত জলধারা, যাঁর শব্দবন্ধে নড়ে উঠত আমাদের ধ্বস্ত বিবেক, যাঁর প্রতিটি শব্দে জন্মভূমির ভিটে কেঁপে ওঠা প্রশ্ন জেগে উঠত—সেই কবির ধ্বনি আজ স্তব্ধ হল। কবি শঙ্খ ঘোষ চলে গেলেন। তার পরিণত বয়েসকে মানতে পারি, কিন্তু কোন সময়ে চলে গেলেন? কিছুদিন আগেই লিখেছিলেন :

মানুষেরা বড়ো বেশি প্রগলভতা করে ফেলে আজ
ক্ষমা করে দাও
কথার নাগাল পেয়ে অকাতরে ব্যবহার করে কিছু কম হতে পারে না কি?
কী জেনেছে মানুষেরা প্রহরে প্রহরে?
ওদের কীভাবে এত গিলে খায় বাচাল সমাজ!

এই বিস্ময় শানিত প্রশ্ন শুনে মনে হয় না, কবি আবার এখনই এই মুহূর্তে কথা বলে উঠছেন। ওই মদ্রস্বরে, গভীর মৃদুতায়, যেখানে আছে অতিনাটকীয়তাহীন আবেগ আর মানুষের প্রতি অকৃপণ ভালোবাসা।

কবিতার জগতে শঙ্খ ঘোষের সঙ্গে যাত্রা করেছেন যে-কবি সমাজ, তাদের প্রায় সকলকেই আমরা একে একে হারিয়েছি। অবশেষে তিনিই ছিলেন আমাদের পরম আশ্রয়শিবির। জিজ্ঞাসা করেছিলাম সবচেয়ে আনন্দ কীসে?― বলেছিলেন, একটি কবিতা লিখে যতটা আপ্লুত হয়ে থাকি, তেমনটা আর কিছুতে নয়। প্রায়ই বলতেন, একটি দুটি বাদ দিলে সারাজীবনে যত গদ্য লিখেছেন, সবই নানাজনের তাড়নায়। – ভাগ্যিস লিখেছেন, তারপর কবিতার মতো তাঁর গদ্যগ্রন্থের সংখ্যা এতটাই এগিয়ে চলল, যা রীতিমতো আমাদের জীবনে এক আনন্দ-সম্ভার।

কবিতাই হোক, আর গদ্যই হোক তা আমাদের পরম প্রাপ্তি হয়ে উঠল কেন, কেন তার সঙ্গ ছাড়তে পারি না? কারণটা তো তিনি নিজেই বলেছেন : ‘কী হবে তা দেখতে পাই না, কিন্তু তবু দৃষ্টি থামাবে কে?/ প্রতিটি মুহূর্ত দেখি অতি দূর ভবিষ্যৎ থেকে।”

এবারের জন্মদিনে নব্বই ছুঁয়ে দেবার আগে থেকেই তিনি একটু অশক্ত হয়ে পড়েছিলেন ঠিকই, তবু তাঁর চিন্তায় মেধায় স্মৃতিতে ভাঙনের ছায়া পড়েনি এতটুকু। দূর ভবিষ্যৎ থেকেই তিনি কিন্তু এই মুহূর্তকে দেখতেন। সকলকে নিরাময় দেবার মতো নিখুঁত মন নিয়ে দেখতেন, দেখাতেন। সেইজন্যই আমরা বলতে পারতাম “দাঁড়ালে তোমার সামনে সব গ্লানি মুছে যেতে থাকে। এমন রাজনৈতিক আবর্তের মধ্যে দিয়ে চলতে হয় নাকি আমাদের? তখন কবির কথাই তো বলতে ইচ্ছে হয় :
সবাই আমার ভালো করতে চায়
ওরা এসে আমার ভালো করতে চাইলে ঘর ছেড়ে এগিয়ে যাই
ওরা কেটে নেয় আমার ডান হাত-খানা ঝুলিয়ে দেয় গাছের ডালে,
এরা এসে আমার ভালো করতে চাইলে মাঠ ছেড়ে এগিয়ে যাই
এরা কেটে নেয় আমার বাঁ-হাতখানা গেঁথে দেয় আলপথে।
একথা তো আমাদের মতো ধ্বস্ত মানুষের জন্যই লিখেছেন শঙ্খ ঘোষ। আবার আমাদের এই বলেও সতর্ক করেছেন :
আমরা অনেক সময়েই সকলের করা কাজটাকে বলতে শুরু করি ‘আমার কাজ’। ব্যক্তিস্তর থেকে রাজনৈতিক স্তর পর্যন্ত এই ‘আমি’ হয়ে ওঠে ঘোষণা-শব্দ, যার মধ্যে দিয়ে এগোতে থাকে জোর দিয়ে বলবার প্রভাবভঙ্গি, আর সেই চোরাপথে এগিয়ে আসে ফ্যাসিবাদ। ফ্যাসিবাদ আমাদের স্বভাবের একটা অনিয়ন্ত্রিত চিৎকার।
শুধু কি পদ্য আর গদ্য – সম্পাদনা, অনুবাদ, অধ্যাপনা আর অল্পবয়সিদের জন্য তাঁর কাজের অন্ত নেই। রবীন্দ্রনাথের প্রতি সার্থক নিবেদনে আর অনুসন্ধানে এক জীবনে কতখানি ব্যাপ্ত চিন্তায় জড়িয়ে রেখেছিলেন নিজেকে। ছড়িয়ে দিয়েছেন আমাদের হাতে পরম উদারতায়।
তাঁর ছোটোদের জন্য একটা ছড়ার বই, নাম ‘আজ আমার পরীক্ষা নেই’। সেই বইয়ে লিখে দিয়েছেন আমাকে:’কিন্তু আমার আছে রোজই’। তাঁর মতো একজন কবির মেধাবী মননশীল মানুষের তো রোজই পরীক্ষা, সময়ের সঙ্গে। জীবনব্যাপী পরীক্ষা দিয়ে গেলেন, আর হয়ে রইলেন আমাদের চিরকালীন শিক্ষক।
তাঁর সর্বশেষ যে গদ্যগ্রন্থটি ক’দিন আগে বেরিয়েছে, তার নাম ‘ছেড়ে-রেখেই ধরে-রাখা’। ‘রাজা’ নাটকে রাজা যেমন সুদর্শনাকে বলেছিলেন : ‘ছেড়ে দেব, কিন্তু যেতে দেব কেন?’—আজ সময় এসে কবিকে ডেকে নিয়ে চলে গেল, তাই ছেড়ে দিতে হল; কিন্তু যেতে দিতে পারি না কিছুতেই। তাঁকে যে ধরে রাখতেই হবে আমাদের। তিনি আমাদের জীবনের চরাচর ছুঁয়ে আছেন।
লেখক – ভবেশ দাশ